শিকলবন্দি দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে এখন সুস্থ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে কিশোরী ফাতেমা। কিশোরগঞ্জ জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের হস্তক্ষেপে রোববার হোসেনপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহযোগিতায় কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে থেকে তাকে পাঠানো হয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন ফাতেমা আগের চেয়ে ভালো আছে। এতে এখন নতুন করে আশার আলো দেখছে ফাতেমার পরিবার।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর কিশোরগঞ্জ জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে সিভিল সার্জন ডা. মো. হাবিবুর রহমান শিকলবন্দি ফাতেমাকে চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। রোববার ফাতেমাকে শিকল মুক্ত করে কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে আনা হয়। সেখানে সিভিল সার্জন ডা. মো. হাবিবুর রহমান ও কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মবিন উদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত একটি মেডিকেল বোর্ড ফাতেমাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।
এ ব্যাপারে ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মজিবুর রহমান জানান, ফাতেমা সিজোফ্রেনিয়া রোগে ভুগছেন। কিশোরগঞ্জে চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে এক মাস চিকিৎসা নিলে ফাতেমা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠবেন।
২১ বছর বয়সী ফাতেমা আক্তারের বাবা হোসেনপুর উপজেলার জিনারী ইউনিয়নের চরকাটিহারি গ্রামের মহিবুর রহমান সরদার বলেছেন, ২০১১ সালে টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করার কারণে এসএসসি পরীক্ষা দিতে না পেরে ফাতেমার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।
ফাতেমার বাবার বক্তব্য অনুযায়ী, অনেক চিকিৎসার পরও ফাতেমার সেই মানসিক সমস্যাগুলো ভালো হয়নি। ফাতেমার আচরণ উগ্র হয়ে উঠলে এক পর্যায়ে তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার সিদ্ধান্ত হয় বলে তার পরিবার জানাচ্ছে।
ফাতেমা আক্তারের চাচাতো ভাই অপু সরদার ফাতেমার এ সমস্যার শুরুর প্রসঙ্গে জানান, ‘২০১১ সালে যখন ফাতেমা এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারল না, তখন থেকেই ওর মন ভেঙে যায়। সব সময় বলত, বন্ধুরা পরীক্ষা দিচ্ছে - কিন্তু আমি দিতে পারলাম না। আস্তে আস্তে তারপর থেকেই ও বিগড়ে যেতে শুরু করে।’ অপু সরদার যোগ করেন, ‘অথচ কী দারুণ ভদ্র মেয়ে ছিল ফাতেমা। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত, আরও কত কিছু করত। সেই মেয়েটাই ধীরে ধীরে একেবারে পাল্টে গেল। বাড়ির লোকজনকে মারধর করতে লাগল, একা একা চুপচাপ বসে থাকত।’
প্রতিবেশীরা তখন অনেকেই বলতেন ফাতেমাকে 'শয়তানে ধরেছে'। সে জন্য কবিরাজি চিকিৎসাও করানো হয়েছিল। পরিবারের আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ হওয়া সত্ত্বেও দেখানো হয়েছিল ডাক্তারকেও।
কিন্তু অপু সরদার বলছিলেন, শেষমেশ কিছুতেই কিছু করা যায়নি। ফাতেমার অবস্থা দিন-কে-দিন ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। টাকাপয়সার টানাটানিতে বছরদুয়েকের পর চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়াও অসম্ভব হয়ে ওঠে।
কিন্তু তাই বলে তাকে শেকলে বেঁধে রাখার মতো নির্মম সিদ্ধান্ত পরিবার কীভাবে নিতে পারল? ফাতেমার যে তাতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল সেটা কি তারা বোঝেননি?
"কষ্ট হলেও বা আমরা কী করতে পারতাম বলেন? মেয়েমানুষ, গায়ে কাপড় রাখছে না - পরিবারের মানসম্ভ্রমেরও তো একটা ব্যাপার থাকে। এলাকার মানুষেও সবাই বলল, মেয়েমানুষ, আপনেরা ওকে বাইন্ধেই রাখেন!" অসহায় গলায় বলেন অপু সরদার।
ফাতেমা নিজে অবশ্য কখনওই শেকলে বাঁধা এই বন্দীজীবন মেনে নিতে পারেনি। সে চিৎকার-চেঁচামেচি করত, বারবার শেকল ছেঁড়ারও চেষ্টা করত।
তবে বছরের পর বছর ফাতেমা-কে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখার খবর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশের পরই পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে থাকে। ফাতেমার বাড়িতে ভিড় করে আসেন সাংবাদিকরা, কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল থেকে প্রাইভেট গাড়ি পাঠিয়ে তাকে পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
তবে ফাতেমার চিকিৎসার উপযুক্ত অবকাঠামো বা বিশেষজ্ঞ কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে না থাকায় তাকে ময়মনসিং মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এর পরই এখন নতুন করে আবার আশার আলো দেখছে ফাতেমার পরিবার। শিকল মুক্ত করে ফাতেমা-কে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে, তার আব্বু-আম্মু ও পরিবারের অন্যরাও সঙ্গেই আছেন।
অপু সরদার জানাচ্ছেন, ‘এখন ও একটু ভাল আছে। একটু স্বাভাবিকই বলব আগের তুলনায়। আবার ওর ঠিকমতো চিকিৎসা হবে শুনে ফাতেমা যেন একটু ভরসাও পেয়েছে। হাসপাতালের বিছানায় শান্তভাবে শুয়ে আছে।’
ফাতেমার দুর্বিষহ শিকলবন্দি জীবন নিয়ে একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে গত ২৯শে জুন প্রথম সংবাদ প্রকাশ করে কিশোরগঞ্জ নিউজ। এরপর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও টেলিভিশনে তাকে নিয়ে সংবাদ প্রচার হয়।
কিশোরগঞ্জ নিউজ-এ প্রকাশিত সংবাদের লিংক: ফাতেমার শিকলবন্দি জীবন