কিশোরগঞ্জ নিউজ :: কিশোরগঞ্জকে জানার সুবর্ণ জানালা


সোহেল রানার মৃত্যুতে পাগলপ্রায় মা, কাঁদছে কিশোরগঞ্জ

 বিশেষ প্রতিনিধি | ৮ এপ্রিল ২০১৯, সোমবার, ৯:১১ | বিশেষ সংবাদ 


বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের সময় আটকে পড়া মানুষজনকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হয়ে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া কিশোরগঞ্জের ছেলে সোহেল রানার যখন চাকরি হয়েছিল, নিয়োগপত্র হাতে পেয়ে মাকে সালাম করে বলেছিলেন, ‘দোয়া করো মা দেশের সেবায় যেন জীবন দিতে পারি।’

২৮ মার্চ। বনানীর এফআর টাওয়ারে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। ভবনের ভিতরে আটকা পড়েছে শত শত মানুষ। পুড়ে অঙ্গার হচ্ছে কেউ কেউ। এর মধ্যে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর বেরিয়ে আসার আপ্রাণ আকুতি। এই মানুষগুলোকে উদ্ধারে অভিযানে যোগ দিয়েছিলেন ফায়ারম্যান সোহেল রানা। ২৩ তলা ওই ভবনে আটকা পড়া মানুষদের ল্যাডারের মাধ্যমে নামাচ্ছিলেন তিনি।

সোহেল রানা। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর ফায়ারম্যান। নিজের জীবন বাজি রেখে একের পর এক মানুষজনকে উদ্ধার করে নিচে নামাচ্ছিলেন। সময়ে ভবনের ভিতরটা আগুনের লেলিহানে আরও উতপ্ত হয়ে উঠছিল। মানুষজন জানালার গ্লাস ভেঙ্গে মাথা বের করে বাঁচানোর আকুতি জানায়। জীবন বাঁচাতে নিচে লাফ দেয় অনেকে।

এ পরিস্থিতিতে সোহেল চার-পাঁচজন আটকে পড়া ব্যক্তিকে উদ্ধার করে নিচে নামাতে চান। উদ্ধারকারী ল্যাডারটি ওভারলোড দেখাচ্ছিল। ওভারলোড হলে সাধারণত সিঁড়ি নিচে নামে না, স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক হয়ে যায়। তাই ল্যাডারের ওজন কমাতে একপর্যায়ে সোহেল নিজেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ল্যাডার থেকে বেয়ে নিচে নামার চেষ্টা করেন। যেন ল্যাডারটির ওজন কমে যাওয়ায়, এবং সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যায়।

এরপরই ঘটে দুর্ঘটনা, যা তার জীবনের আলো নিভিয়ে দিল। ল্যাডারের ভেতরে সোহেলের একটি পা ঢুকে যায়। এ সময় তার শরীরের সেফটি বেল্টটি ল্যাডারে আটকে পেটে প্রচণ্ড আঘাত লাগে। এরপর থেকেই সংজ্ঞাহীন সোহেল। দুর্ঘটনার পরপরই সোহেলকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। সেখানে প্রতিদিন চার ব্যাগ রক্ত দেয়া হলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী উন্নতি হচ্ছিল না। পেটের ক্ষতের কারণে সমস্যা হচ্ছিল রানার।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য গত শুক্রবার (৫ এপ্রিল) সোহেল রানাকে পাঠানো হয় সিঙ্গাপুর। তার দেখাশোনা করার জন্য ফতুল্লা ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার রায়হানুল আশরাফকেও তার সঙ্গে পাঠানো হয়। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে সোমবার স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৭ মিনিট) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মারা যান দেশের সেবায় নিয়োজিত এক রিয়েল হিরো। মায়ের কাছে দোয়া চেয়ে এই মৃত্যুই যেন চেয়েছিলেন সোহেল।

মৃত্যুর খবরে সোহেলের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। প্রিয় সন্তানের অকাল মৃত্যুতে পাগলপ্রায় মা হালিমা খাতুন। বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি। ভাইকে হারিয়ে কাঁদছে ছোট দুই ভাই রুবেল ও দেলোয়ার। আরেক ভাই উজ্জ্বল ঢাকায় অপেক্ষা করছেন, কখন আসবে ভাইয়ের মরদেহ! কৃষক বাবা নুরুল ইসলাম বাকরুদ্ধ। বড় বোন সেলিনা আক্তার করছেন বিলাপ।

শুধু পরিবারের লোকজনই নয় নয় এলাকাবাসীও যেন নিথর হয়ে গেছে তার এই মৃত্যুতে। সোহেলের মৃত্যুর খবরে সকাল থেকেই এলাকার লোকজন তাদের বাড়িতে এসে ভিড় জমায়। সকাল থেকে দূর-দূরান্তের মানুষ এসে ভিড় করছে তাদের বাড়িতে।

সোমবার (৮ এপ্রিল) বিকেলে সোহেলের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার চৌগাঙ্গা ইউনিয়নের কেরুয়ালা গ্রামে সোহেলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কিছুতেই কান্না থামছে না সোহেল রানার মা হালিমা খাতুনের। চারদিকে কান্নার রোল। প্রিয় ভাইয়ের মৃত্যুর খবরে বুক চাপড়ে মাতম করছেন ছোট দুই ভাই ও একমাত্র বোন। বাকরুদ্ধ বাবার চোখে শুধু পানি। এমন একজন পরোপকারী ও ভালো মানুষের মৃত্যুতে পুরো জেলার মানুষ যেন শোকাহত হয়ে পড়েছে।

সোহেল রানার ছোট ভাই রুবেল মিয়া জানান, সর্বশেষ গত ১৫ই মার্চ ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন সোহেল রানা। ছুটি শেষে ২৩শে মার্চ তিনি কর্মস্থলে যোগ দেন। কর্মস্থলে যোগ দেয়ার মাত্র ৫দিন পরেই ২৮শে মার্চ ঘটে বনানীর এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মর্মন্তুদ ঘটনা।

রুবেল বলেন, ভাই-ই ছিলেন আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁর মৃত্যু আমাদের স্তব্ধ করে দিয়েছে। সামনে আমাদের জীবন অন্ধকার। এখন একমাত্র সরকারই পারে আমাদের এই অকুলপাথার থেকে বাঁচাতে।

সিঙ্গাপুর প্রবাসী মামাতো ভাই শফিকুল ইসলামের বরাত দিয়ে ফায়ারম্যান সোহেল রানার ছোট ভাই রুবেল মিয়া জানান, সোমবার (৮ এপ্রিল) বাংলাদেশ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সিঙ্গাপুর থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সোহেল রানার মরদেহ দেশে পাঠানো হবে। রাত সাড়ে ১০টায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটির অবতরণ করার কথা রয়েছে।

মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) সোহেল রানার মরদেহ কেরুয়ালা গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হবে। স্থানীয় ঈদগাহ মাঠে জানাজা শেষে গ্রামের কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হবে।

বিকাল ৪টার দিকে রুবেলের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে হাওর থেকে বাড়িতে ফিরেন সোহেল রানার বাবা নূরুল ইসলাম। তখনও তিনি জানতেন না, তার আদরের ধন সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে দূরে বহুদূরে। বাড়িভর্তি মানুষজন আর স্ত্রী-কন্যা-স্বজনদের কান্না আর আহাজারি দেখে তিনি নির্বাক হয়ে যান। বুঝতে পারেন, সোহেল রানার মৃত্যুর সাথে সাথে তাঁর শেষ আশার প্রদীপটিও যে নিভে গেছে। তাঁর চোখের কোণ বেয়ে নিরবে ঝরে পড়ে অশ্রুবিন্দু।

সোহেল রানার বাল্যবন্ধু শহীদুল ইসলাম জানান, সোহেল খুব বন্ধুবৎসল ছিল। তার মাঝে কোন হিংসা-বিদ্বেষ ছিল না। মানুষের সাথে মেশার তার অসাধারণ একটি গুণ ছিলো। যে কারণে সে সহজেই সবার সাথে মিশতে পারতো।


[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ি নয়। মতামত একান্তই পাঠকের নিজস্ব। এর সকল দায়ভার বর্তায় মতামত প্রদানকারীর]

এ বিভাগের আরও খবর