কিশোরগঞ্জ নিউজ :: কিশোরগঞ্জকে জানার সুবর্ণ জানালা


ভৈরবে সংরক্ষিত এলাকায় কয়লার স্তুপ, হুমকির মুখে পরিবেশ, প্রতিবেশ, তিতাস গ্যাস কন্ট্রোল স্টেশন

 সোহেল সাশ্রু | ২৪ এপ্রিল ২০১৮, মঙ্গলবার, ৮:২৬ | ভৈরব 


দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী মেঘনা, বড় দুটি রেলসেতু ও শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সড়ক সেতুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বন্দর নগরি ভৈরবের উদীয়মান পর্যটন শিল্প কয়লার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে তিতাস গ্যাসের ডিস্ট্রিবিউশন রেগুলেটিং স্টেশন (ডিআরএস)। প্রভাবশালী মহল সেতু দুটির নীচে ও আশপাশে রেলওয়ে এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের সংরক্ষিত এলাকা দখল করে কয়লার স্তুপ জমা করছে। এর ফলে চারদিকের সুন্দর সবুজ শ্যামল পরিবেশ কালচে রং ধারণ করছে। মরে যাচ্ছে সেতু এলাকার বৃক্ষরাজী, মরে যাচ্ছে সড়কের ঘাসও।

কর্তৃপক্ষের উপযুক্ত নজরদারির অভাব ও প্রশাসনের নিরবতার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে এলাকার রেল, সড়ক ও জনপথের অবশিষ্ট বৃক্ষরাজীসহ এলাকার সার্বিক পরিবেশ। এছাড়া মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে তিতাস গ্যাসের ডিস্ট্রিবিউশন রেগুলেটিং স্টেশন (ডিআরএস)। কয়লা একটি উচ্চ মাত্রার দাহ্য পদার্থ হবার কারণে যে কোন সময় ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনার কথা চিন্তা করে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ এখানে রাখা কয়লা সরিয়ে নেয়ার জন্যে সংশ্লিষ্ট কয়লা ব্যবসায়ীদের কয়েক দফা নোটিশ দিলেও ব্যবসায়ীরা স্থানীয় ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় কর্ণপাত করেননি।

বন্দর নগরি ভৈরব ও আশুগঞ্জের মধ্যে সড়ক ও জনপথ কর্তৃক ‘শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু’ নির্মাণ হবার পর থেকে রেলসেতু ও সড়ক সেতুকে ঘিরে ভৈরবে পর্যটন কেন্দ্র বিকশিত হবার পথ সুগম হয়। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা দৃষ্টিনন্দন সেতুগুলো দেশের নানান প্রান্ত থেকে আসা পর্যটক ও দর্শণার্থীদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। এছাড়া বৈশাখে এখানকার দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈশাখী মেলা সবাইকে দারুণভাবে মুগ্ধ করে। ফলে দেশ-বিদেশের পর্যটকগণ এখানে ভ্রমণ বিলাসের জন্য ছুটে আসেন। স্থানীয় বাসিন্দারাও প্রাতঃভ্রমণ, ব্যায়াম আর বৈকালিক অবকাশ যাপনে সেখানে ছুটে যান নদীর ছন্দোময় ঢেউ আর নির্মল প্রাকৃতিক হাওয়ার পরশ নিতে। ফলে এ স্থানটি সারা বছরই থাকতো কোলাহলময়। এভাবে এ স্থানটি একটি আদর্শ পর্যটন কেন্দ্রের রূপ নিয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছর ধরে সেই চেনা দৃশ্যটি ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে, বিবর্ণ ম্রিয়মান হয়ে পড়ছে।

এখন আর আগের মত পর্যটক কিংবা দর্শনার্থীদের ভীড় নেই। সব কিছু কেমন কালচে হয়ে গেছে। আগের সবুজ শ্যামল দৃশ্যের পরিবর্তে চারিদিকে শুধু কয়লা আর কয়লার স্তুপ দেখা যায়। বাতাসে ছড়াচ্ছে উৎকট গন্ধ। কয়লার উত্তাপে মরে শেষ হতে চলেছে সবুজ গাছ-গাছালি। ইতোমধ্যে রেলের বৃহৎ দুটি আমগাছ, দুটি কাঁঠাল গাছসহ অনেকগুলো গাছ মরে গেছে। কর্তৃপরে শক্তিশালী ভূমিকা না থাকা ও প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় প্রভাবশালী চক্র সড়ক সেতুর লৌহজালের বেষ্টনী ভেঙে এর ভেতরেও রাখছে কয়লা। ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি সরকারের কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। দুশ্চিন্তার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে তিতাস গ্যাসের ডিস্ট্রিবিউশন রেগুলেটিং স্টেশন (ডিআরএস)। কয়লার উত্তাপের কারণে যে কোন সময় বিস্ফোরণ হতে পারে, বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও সচেতন মহলের দাবি, অনতিবিলম্বে রেল ও সড়ক সেতু সংলগ্ন সংরতি এলাকা ও এর আশপাশের সরকারি জমি প্রভাবশালী মহলের দখলদারিত্বের হাত থেকে উদ্ধার করে কয়লার স্তুপ অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। যেন এলাকাটিকে দুর্ঘটনার আশঙ্কামুক্ত করা হয়। তাছাড়া পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে এলাকাটিকে রক্ষা করে হারানো সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি এ স্থানটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। উল্লেখ্য, এ বিষয়ে ২০১৬ সালের একাধিক সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের কোন তৎপরতা দেখা যায়নি।

এদিকে গেল পহেলা বৈশাখের আগের দিন সকালে ভৈরবের পরিবেশবাদী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘দি ব্ল্যাকহোল এসোসিয়েট’ এর আয়োজনে সামাজিক আন্দোলন হিসেবে গোসল উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এসময় কেপিআইভূক্ত এলাকা থেকে কয়লা ব্যবসা অন্যত্র সরিয়ে নিতে ও পরিবেশ রক্ষাসহ দেশের নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট বন্ধের দাবিতে মাবনবন্ধন করেছে তারা।

এ বিষয়ে ভৈরব পৌরসভার মেয়র মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ফখরুল আলম আক্কাছ বলেন, শহরের একমাত্র বিনোদন স্পট ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকা মেঘনা নদী পাড়ের ত্রি-সেতু এলাকাটি। যে দৃশ্য আগত দর্শণার্থী ও পর্যটকদের মুহুর্তেই নজর কাড়ে। একই সাথে আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করে। কিন্তু, সমাজের কতিপয় কয়লা ব্যবসায়ীদের কারণে এলাকাটি তার নিজস্ব সৌন্দয্যের্র রূপ হারিয়ে ফেলেছে।

কয়লায় পরিবেশ দূষণের ফলে মুক্ত বাতাস এখন দুষণযুক্ত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এই গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি উদ্ধারে স্থানীয় প্রশাসন, সামাজিক ও রাজনৈতিক মহলের লোকজনসহ সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

দেশের বন্দর নগরী ভৈরব শহরের অতুলনীয় পর্যটন এলাকাটির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে ভৈরব উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ কাজী ফয়সাল জানান, এলাকাটি আমাদের নজরে এসেছে। যদিও সময়ের ব্যপার, তারপরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে চির চেনা স্থানটির আসল রূপ ফিরেয়ে এনে আগের মত পর্যটক কিংবা দর্শণার্থীদের জন্য বসার ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তাছাড়া স্থানটি উদ্ধারে আমারা এরই মধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছি।

জানতে চাইলে নরসিংদী সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান মুঠোফোনে বলেন, আমাদের নিয়ন্ত্রিত সংরক্ষিত এলাকাটিতে জোরপূর্বক বেড়া ও খুঁটি ভেঙ্গে প্রবেশ করে প্রভাবশালী মহলের কিছু লোকজন কয়লার ব্যবসা পরিচালনা করছেন। আমরা ইতোমধ্যে সংরক্ষিত এলাকাটি উদ্ধার ও কয়লা ব্যবসা উচ্ছেদে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রসাশন বরাবরে লিখিত আবেদন করেছি। আশা করছি অল্প সময়ের মাধ্যমে একজন ম্যজিস্ট্রেট নিয়োগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা নেয়া হবে।


[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ি নয়। মতামত একান্তই পাঠকের নিজস্ব। এর সকল দায়ভার বর্তায় মতামত প্রদানকারীর]

এ বিভাগের আরও খবর