বার ভূঁইয়াখ্যাত ঈশাখাঁর বীরত্বপূর্ণ ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ এগারসিন্দুর দুর্গ। বিশাল আকারের দুর্গটি ছিল ঈশাখাঁর শক্ত ঘাঁটি। মোগলরা বারবার আক্রমণ করেও এ দুর্গের পতন ঘটাতে পারেনি।
ইতিহাসবিদদের মতে, দুর্গের পশ্চিম দিকে ছিল প্রশস্ত পরিখা, উত্তর ও পূর্ব দিকে ছিল শঙ্খ নদীর বাঁক দ্বারা সৃষ্ট স্বাভাবিক পরিখা এবং দক্ষিণে ছিল বিশাল ব্রহ্মপুত্র। ১৮৯২ সালের ভূমিকম্পে দুর্গটি ধ্বংস হয়ে গেলেও আজো কিছুকিছু নিদর্শন আছে যা দেখে আন্দাজ করা যায় দুর্গটির অবস্থান।
দুর্গ এলাকার জাফরি ইট, অজানা সুরঙ্গ, মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ দেখে এটির নির্মাণকাল যে প্রাচীন যুগে তা আন্দাজ করা যায়। এখনো দুর্গের ভিতরে উঁচু একটি টিলার মতো ঢিবি দাঁড়িয়ে আছে যেখান থেকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কামান দাগানো হতো। এটিই বর্তমানে দুর্গের একমাত্র আকর্ষণ।
কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে এগারসিন্দুর। গ্রামের নামেই পাকুন্দিয়ার এই ইউনিয়নের নাম। এখানে রয়েছে এগারসিন্দুর দুর্গ যেটি দখল করে কৌশলগত অবস্থান নিয়ে বীর ঈশাখাঁ মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ করেছিলেন।
লাল মাটি, সবুজ গাছগাছালি আর ঐতিহাসিক নিদর্শনে সমৃদ্ধ এগারসিন্দুর। জনশ্রুতি রয়েছে, ১১টি নদীর মোহনায় ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে উঁচু শক্ত এঁটেল লাল মাটির এলাকা ব্যবসা বাণিজ্য ও বসবাসের স্থান হিসেবে উৎকৃষ্ট বিবেচিত হওয়ায় গঞ্জের হাট নামে এটি প্রসিদ্ধ ছিল। হাটটি ১১টি নদীর সংগমস্থলে হওয়ায় স্থানীয়রা ১১টি নদীকে সিন্দু আখ্যায়িত করে গঞ্জের হাট থেকে স্থানটির নামকরণ করেন এগারসিন্দুর।
সেখানে রাজধানী স্থাপন করে পঞ্চদশ শতাব্দীতে বেবুদ নামে এক কোচ সামন্তরাজ বসবাস করতেন। নিরাপত্তা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিনি তখন এগারসিন্দুর দুর্গটি নির্মাণ করেন বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। ১৫৮৬ খ্রীস্টাব্দে মসনদে আলা ঈশাখাঁ মোগল সুবেদার শাহবাজ খাঁকে রণচাতুর্যে পরাজিত করে সোনারগাঁয়ে রাজধানী স্থাপন করে রাজ্যবিস্তারে মনোনিবেশ করেন। সে সময় ঈশা খাঁ বেবুদ রাজার কাছ থেকে দুর্গটি দখল করেন এবং একে শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করেন।
এ দুর্গের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঈশাখাঁ ও মোগল সেনাপতি রাজা মানসিংহের সম্মুখ যুদ্ধ। মানসিংহকে পরাজিত করেও তাকে হত্যা না করে বিরল উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন ঈশাখাঁ। তাঁর সৌজন্যতায় মুগ্ধ হয়ে মানসিংহ ঈশাখাঁর সঙ্গে সন্ধি করেছিলেন। এছাড়া এগারসিন্দুর দুর্গে বহুল আলোচিত ঈশা খাঁ’র দ্বিতীয় বিবাহ মহাধুমধামে অনুষ্ঠিত হয়। সৈয়দ ইব্রাহীম মালেকুল উলামার কন্যা ও ঈশা খাঁর খালাতো বোন সৈয়দা ফাতেমা বানুকে ঈশা খাঁ প্রথমে বিবাহ করেন।
বার ভূঁইয়া’র অন্যতম বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদ রায়ের বাল্য বিধবা কন্যা স্বর্ণময়ীর সঙ্গে ঈশা খাঁ’র প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ নিয়ে প্রচলিত কাহিনীট হচ্ছে, মোগল বিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রামের ব্যাপারে জমিদার চাঁদ রায়ের বাড়িতে সলাপরামর্শের জন্য ঈশা খাঁর যাতায়াত ছিল। বিধবা অথচ রাজকার্যে পারদর্শী স্বর্ণময়ী ওই পরামর্শ সভায় যোগ দিতেন। এভাবেই দু’জনের পরিচয় প্রেমের সম্পর্কে গড়ায়। ঈশা খাঁ চাঁদ রায়ের কাছে বিয়ের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেন। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ হয় এবং যুদ্ধ বেধে যায়। যুদ্ধের সময় রায়নন্দিনী স্বর্ণময়ী ঈশা খাঁর নিকট সশস্ত্র রক্ষীসহ দ্রুতগামী নৌকা পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে শ্রীমন্ত খাঁ নামে এক বিশ্বস্থ রাজ কর্মচারীকে পাঠান। পরিকল্পনা অনুযায়ী শ্রীমন্ত খাঁর সাথে ‘কোটিশ্বরের’ মন্দিরে পূজা দেওয়ার ছল করে স্বর্ণময়ী নৌকাযোগে প্রথমে সোনারগাঁও এবং পরে এগারসিন্দুরে এসে পৌঁছান। এদিকে যুদ্ধে চাঁদ রায় ও কেদার রায় পরাজিত হন। যুদ্ধের পর এগারসিন্দুর দুর্গে মহাধুমধামে তাঁদের বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর স্বর্ণময়ীর নাম রাখা হয় অলী নিয়ামৎ খানম।
দুর্গের পাশেই রয়েছে বিশালায়তনের বেবুদ রাজার দীঘি এবং প্রাচীন দু’টি মসজিদ। বেবুদ রাজা প্রজাদের জলকষ্ট দূর করতে ৫০ একর জমির ওপর একটি দীঘি করেছিলেন। এর পানি এখনো খুব স্বচ্ছ। এর তিন পাশে সবুজ গাছগাছালির কারণে পুকুরটিকে আরো সুন্দর দেখায়। এর স্বচ্ছ জলে যখন গাছের ছায়া পড়ে তখন আশপাশ যেন আরো সুন্দর হয়ে ফুটে থাকে। এই দীঘি নিয়ে বেবুদ রাজার অনেক কিংবদন্তী প্রচলিত রয়েছে, যা আজো বেবুদ রাজার অস্তিত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়।
এছাড়া প্রাচীন মসজিদ দু’টির মধ্যে ১৬০০ সালের দিকে নির্মিত শাহ মাহমুদের মসজিদ, ভিটা ও বালাখানা এবং সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে ১৬৫২ সালে নির্মিত পোড়ামাটির অলঙ্করণসমৃদ্ধ ইটের তৈরি সাদী মসজিদ পুরাকীর্তির অনন্য নিদর্শন।
এগারসিন্দুর গ্রামে আরো কিছু ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন আছে তার মধ্যে নিরগীন শাহ ও শাহ গরীবউল্লাহর মাজার, অধিকারী মঠ, মঠখলা কালী মন্দির, দেওল মন্দির, নীলকরের কুঠি উল্লেখ করার মতো। তাছাড়া ছোট ছোট মাটির ঘরে থরে থরে সাজানো গ্রামের শ্যামলসবুজ ছায়াঘেরা শান্ত পরিবেশের দুর্নিবার আকর্ষণ তো রয়েছেই।
১৫৯৯ খ্রীস্টাব্দে মসনদে আলা ঈশাখাঁর মৃত্যুর দীর্ঘদিন পরও এগারসিন্দুরের গৌরবগাঁথা, জমজমাট নৌবন্দর, ব্যবসাকেন্দ্র, ধর্ম প্রচারক পীর আওলিয়া এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাসস্থান হিসেবে এর সুনাম অক্ষুন্ন ছিল। কিন্তু সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে ১৬৩৮ খ্রীস্টাব্দে অহমরাজ প্রায় ৫০০ যুদ্ধযানসহ ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে এসে এগারসিন্দুর বন্দর আক্রমণ ও লুটতরাজ করে বন্দরটি ধ্বংস করে দেন। খবর পেয়ে বাংলার সুবেদার ইসলাম খাঁ দ্রুত অগ্রসর হয়ে এগারসিন্দুর এলাকায় অহমরাজের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অহমরাজ আসামের দিকে পালিয়ে যান। সে যুদ্ধে বন্দরটি আরো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। পরবর্তীতে ১৮৯২ সালের ভূমিকম্পে এগারসিন্দুর দুর্গটি ধ্বংস হয়ে যায়।