কিশোরগঞ্জ নিউজ :: কিশোরগঞ্জকে জানার সুবর্ণ জানালা


মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অজানা অধ্যায়ের অনবদ্য অংশ - ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম বীর প্রতীক

 সাইফুল হক মোল্লা দুলু | ১৪ ডিসেম্বর ২০২০, সোমবার, ১১:৪৩ | মুক্তিযুদ্ধ 


একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ হাসপাতালের ইতিহাসটি অনেকের জানা নেই। মুক্তিযুদ্ধের দুঃসময়ে আহত মুক্তিযোদ্ধা, সৈনিক এবং সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবায় হাসপাতালটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। অথচ বর্তমান প্রজন্মের তরুণসহ দেশের অধিকাংশ মানুষ এই অনন্য ইতিহাস সম্পর্কে ততটা অবগত নয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা পরিচালিত সম্পূর্ণ বাঁশ দিয়ে তৈরি ৪০০ শয্যার বাংলাদেশ হাসপাতালটি আগরতলার বিশ্রামগঞ্জে অবস্থিত ছিল। ২নং সেক্টরের অধীনে ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম (বীরপ্রতীক) এ হাসপাতালে কমান্ডিং অফিসার (C.O) হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।

হাসপাতালটিতে ৪/৫ জন মেডিকেলের শেষ বর্ষের ছাত্র কর্মরত ছিলেন। লন্ডন থেকে ডা. মবিন, ডা. জাফরুল্লাহ, ডা. কিরণ সরকার দেবনাথ, ডা. ফারুক মাহমুদ, ডা. নাজিমুদ্দিন, ডা. আকতার, ডা, মুর্শেদ প্রমুখ এ হাসপাতালে কাজ করেছেন।

১০/১২ জন ভলেন্টিয়ার আর্মি থেকে এসেছিলেন। সুবেদার লেবেলের উপরে কেউ ছিলেন না। কোন ভারতীয় চিকিৎসক এ হাসপাতালে নিয়মিতভাবে থাকতেন না।

রোগীদের ঔষধের জন্য আগরতলার উদয়পুরে যেতে হতো ডা. সেতারা বেগমকে। উদয়পুরের ডিসি মি. ব্যানার্জী আগরতলার এডুকেশন বোর্ডের পরিচালক ড. চ্যাটার্জী মজুমদার এবং ডা. চক্রবর্তী এ হাসপাতালের জন্য প্রচুর সাহায্য সহযোগিতা করেছেন।

এ হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার (O.T) ছিল। প্লাষ্টিক দিয়ে থিয়েটারের মেঝে সম্পূর্ণ ঢাকা থাকতো। হাসপাতালে শুধু বাঙ্গালী রোগী, আহত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধারাই চিকিৎসার জন্য আসতেন তা নয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরাও বাংলাদেশ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসতেন। জেনারেল রব হেলিক্টারে গুলিবিদ্ধ হলে তিনি বাংলাদেশ হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেন।

ডা. ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম একাত্তরের জুলাই এর শেষ দিকে বাংলাদেশ হাসপাতালে সিও হিসেবে যোগদানের পর গোটা হাসপাতালটিতে সুশৃঙ্খল পরিবেশ ফিরে এসেছিল। তিনি তাঁর মেধা, শ্রম, দক্ষতা ও সেবা দিয়ে সকলের মন জয় করেছিলেন। মুক্তিপাগল বাঙ্গালিদের সাহস ও শক্তি যুগিয়েছেন।

বীরপ্রতীক সিতারা বেগমের জন্ম ১৯৪৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতার তালতলায়। মো. ইছরাইল মিয়া ও হাকিমুন্নেছার দুই ছেলে তিন মেয়ের মধ্যে সিতারার স্থান তৃতীয়। বাবার আইন ব্যবসার সূত্র ধরে কিশোরগঞ্জ পৈতৃক বাড়ীতে তার শৈশব কেটেছে।

১৯৬১ সালে সিতারা বেগম কিশোরগঞ্জ এস.ভি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, ঢাকা হলিক্রস কলেজ থেকে বিজ্ঞানে PRE-MEDICAL ও ১৯৬৩-৬৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে ইন্টার্নিশীপ করে চিকিৎসক হন।

স্কুল জীবনে তিনি গার্লস গাইডে দল নেতা ছিলেন। অত্যন্ত তুখোড় ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় হিসেবে শিক্ষাঙ্গণে তার সুখ্যাতি ছিল। শিক্ষা জীবনে তিনি ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়নসহ বহু খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করে প্রচুর সুনাম ও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।

চিকিৎসক হওয়ার পর ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে তিনি সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে লেফটেন্যান্ট হিসেবে চাকুরীতে যোগদান করেন। ’৭০ এর আগুনঝরা দিনগুলোতে সিতারা বেগম কুমিল্লা সেনানিবাসে ছিলেন।

ঠিক একই সময় তার বড় ভাই স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সেনানী মেজর এটিএম হায়দার বীর উত্তম (এসএসজি) (’৭৫-এর ৭ নভেম্বর নিহত) পাকিস্থানের চেরাট (পিন্ডি) থেকে বদলী হয়ে কুমিল্লায় ৩য় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে (এসএসজি) যোগ দেন। ৫ ফেব্রুয়ারী ’৭১ রোজার ছুটিতে দুই ভাই বোন কিশোরগঞ্জের বাসায় আসেন।

হায়দার ছুটি শেষ করে ফিরে গেলেন। ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগমের ছুটি শেষ হওয়ার পূর্বেই দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়।

’৭১ মার্চের প্রথম সপ্তাহে হায়দার ক্যান্টনমেন্ট থেকে লুকিয়ে ঢাকায় ফুফার বাসায় দেখা করে সিতারা বেগমকে সেনাবাহিনীতে যোগদান না করার জন্য বলেন। তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান না করে কিশোরগঞ্জের বাসায় ফিরে এলেন।

মার্চের শেষ সপ্তাহে কিশোরগঞ্জ রেল স্টেশনে পাকিস্তানীরা বিমান আক্রমণ করল। সিতারা বেগম পালালেন, মামার শ্বশুর বাড়ীতে। দুই সপ্তাহ পর আবার কিশোরগঞ্জে।

এর মধ্যে কুমিল্লা সিএমএইচ থেকে ২/৩টি টেলিগ্রাম এলো চাকুরীতে যোগদান করার জন্য। বাবা উত্তরে পাঠালেন- সেতারা বেগম অসুস্থ।

কিশোরগঞ্জ থাকার পর মিলিটারী আসার মাত্র দুই দিন পূর্বে শহরের ১০/১২ মাইল উত্তরে হোসেনপুর মা’র নানার বাড়ী তিনি পালিয়ে গেলেন। শহরে লিফলেট ছাড়া হলো এ পরিবারকে ধরিয়ে দিলে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।

জুলাই ’৭১ শেষের দিকে বীরযোদ্ধা মেজর হায়দার মুক্তিবাহিনীর সদস্য পাঠালেন। এদের সাথে বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে কিশোরগঞ্জের গোজাদিয়া ঘাট দিয়ে নৌকায় ৮/১০ দিন পর মেঘালয় পৌঁছেন। তারপর সিলেটের টেকেরঘাটে এক সপ্তাহ। সেখান থেকে ট্রাকযোগে শিলং।

শিলং এ ৪/৫ দিন থাকার পর অসুস্থ বাবা-মাকে নিয়ে সকল যন্ত্রণা, উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে গোহাটী দিয়ে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে মেলাঘরে পৌঁছেন এবং বাংলাদেশ হাসপাতালে যোগদান করেন।

১৬ ডিসেম্বর ’৭১ রাতে বিশ্রামগঞ্জে বাংলাদেশ হাসপাতালে রেডিওর মাধ্যমে ডা. সিতারা বেগম ও তাঁর সহকর্মীরা ঢাকা মুক্ত হওয়ার সংবাদ পান। ডিসেম্বরের শেষের দিকে তিনি কলকাতায় বদলী হন। এক সপ্তাহ পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন।

মুক্তিযুদ্ধে এ মহিয়সী নারীর সাহসী আবদানের জন্য ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা  হয়।

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিগেডিয়ার পান্ডে (এলএ) ঢাকায় এলে (Where is that brave lady) কোথায় সেই সাহসী নারী? এই বলে সকলের উপস্থিতিতে এই বীর প্রতীকের প্রশংসা করেছিলেন।

ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম ১৯৭২ এর অক্টোবরে ক্যাপ্টেন আবেদুর রহমানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ক্যাপ্টেন আবেদ একজন চিকিৎসক এবং মুক্তিযোদ্ধা। তিনি জেনারেল শফিউল্লাহর অধীনে ৩ নং সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন।

স্বামী ৭৩ এ উচ্চ শিক্ষার্থে দেশের বাইরে গেলেন। তাকেও সঙ্গে যেতে হলো। যাওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলেন। বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেছিলেন, তোমরা যারা যুদ্ধ করলে তারা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছ?

বড় ভাই হায়দারের মৃত্যু তার জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক স্মৃতি। যে গেরিলা কমান্ডারকে হানাদাররা স্পর্শ করতে পারেনি স্বাধীন দেশে তাকে ষড়যন্তকারীরা হত্যা করেছে।

তার মতে, যেহেতু আমি দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম তাই হয়তো প্রাণে বেঁচে আছি। নয়তো অন্য সবার মতো আমাকেও কোন না কোন ষড়যন্ত্রের জালে ফেলে হত্যা করা হতো।

প্রবাস জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, বড় ভাই লেফটেন্যান্ট কর্ণেল হায়দার বীর উত্তমকে হত্যার পর দেশের প্রতি তীব্র অভিমান ছিল। দেশের পতাকা দেখলে আমার কান্না আসতো।

ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম দুই মেয়ে ও এক ছেলের জননী। বর্তমানে স্বামী সহ আমেরিকায় বসবাস করছেন। সম্প্রতি তিনি দেশে এসেছিলেন।

তিনি জানান, সুযোগ পেলে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাজ করার উদ্দেশ্যে দেশে আসবেন এবং সন্তানদের সময়মতো তিনি দেশে পাঠাবেন।

কিশোরগঞ্জের বাসায় তার ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা এটিএম সাফদার জিতু বলেন, বিশ্রামগঞ্জে বাংলাদেশ হাসপাতাল মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য দলিল। অথচ এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্যভাবে স্থান পায়নি। বিষয়টি দুঃখজনক।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাধারণত বিজয় মাসে তিনি তার প্রিয় বাংলাদেশে একাধিকবার এসেছেন। নিরবে নিভৃতে কাজ করে আবার তিনি ফিরে যান সুদূর আমেরিকায়।


[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ি নয়। মতামত একান্তই পাঠকের নিজস্ব। এর সকল দায়ভার বর্তায় মতামত প্রদানকারীর]

এ বিভাগের আরও খবর